রাজশাহীর পদ্মার ১০০ বিঘা চর দখলে আ'লীগ-বিএনপি ভাই ভাই!

নিউজ ডেস্ক : দুই সহোদরের মিল-মহব্বতের তুলনা নেই। আওয়ামী লীগ-বিএনপির রেষারেষির মধ্যে পড়ে যে দেশ খাবি খাচ্ছে, সেই দেশের তো এ রকম ভ্রাতৃত্বই দরকার! রাজশাহী শহরের কাছাকাছি পদ্মা নদীতে জেগে ওঠা এক বিশাল চরের ১০০ বিঘা জমি দখল করে চাষবাস করছেন এমন দুই ভাই, যাঁদের একজন আওয়ামী লীগের নেতা, অন্যজন বিএনপির যুব সংগঠন যুবদলের নেতা।
সাগর শেখ আর রুবেল শেখ সরকারি খাসজমিতে নিজেদের জমিদারি গড়ে তুলেছেন, দুই প্রতিপক্ষ দলের রাজনৈতিক বৈরিতা এ ক্ষেত্রে বাদ সাধতে পারেনি। লোকে যে বলে, আওয়ামী লীগ-বিএনপির মধ্যে বৈরিতার কারণে জাতির ভোগান্তির শেষ নেই, এই দুই ভাইয়ের বেলায় তা মিথ্যা হয়ে গেছে।
দেশের আরও অনেক এলাকায় এমন দৃষ্টান্ত মিলবে যে জবর দখল, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসাসহ নানা রকমের অপরাধকর্মে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির স্থানীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে চমৎকার বোঝাপড়া কাজ করে। শুধু তা-ই নয়, কী কারণে যেন তাঁদের অপরাধবৃত্তি দমনের ক্ষেত্রে স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষ বিশেষ তৎপরতা দেখায় না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নতুন চরের এই এলাকাটি রাজশাহীর পবা উপজেলার কাপাশিয়া ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়ের কাদিপুর, চররামপুর ও চরবিন্দাদহ মৌজার মধ্যে পড়েছে। এর পুরোটাই খাসজমি। এর মালিক জেলা প্রশাসক। চরটি স্থায়ী হলে জেলা প্রশাসন সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী বন্দোবস্ত দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারে।
ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, পাওয়ার টিলারে চাষ চলছে। চারদিকে চর দখলের হিড়িক পড়ে গেছে। এই দখলদারের মধ্যে রয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা, সৈনিক লীগ নেতা, যুবদল নেতা, ক্রীড়াবিদ, মাদক ব্যবসায়ীসহ এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। স্থানীয় ভূমি কার্যালয় এ রকম ৫৩ জন দখলদারের পরিচয় পেয়েছে।
স্থানীয় লোকজন আরও জানান, রাজশাহী মহানগরের ৯ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. সাগর শেখ এই চরের ১০০ বিঘা জমি চাষ করছেন। তাঁর ভাই রুবেল শেখ একইভাবে চরের জমি চাষ করছেন। রুবেল শেখ একই ওয়ার্ডের যুবদলের সভাপতি। দুই ভাই দুটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে থাকলেও একই সঙ্গে চরের জমি দখল করে চাষ করছেন।
এ ব্যাপারে সাগর শেখ বলেন, বিজিবি পার্কের নিচে তিনি দুটি প্লটে ১০০ বিঘা জমি চাষ করছেন। বিজিবির কাছ থেকে ইজারা নিয়ে বৈধভাবে তাঁরা এই জমি চাষ করছেন।
তবে পবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (বর্তমানে এসি ল্যান্ডের দায়িত্বেও রয়েছেন) আলমগীর কবির বলেন, খাসজমির মালিক জেলা প্রশাসক। তিনি ছাড়া এই জমি কেউ ইজারা দিতে পারবে না। বিজিবি পার্ক যেখানে করেছে, সেই জমিটুকু তাদের ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
এদিকে, চর শ্যামপুর এলাকার আসমত আলী বেশ কিছু শ্রমিক নিয়ে ধান রোপণ করছেন। তিনি দাবি করেছেন, জিল্লু সরদারের কাছ থেকে তিনি ১০ বিঘা জমি ইজারা নিয়ে চাষ করছেন। জিল্লুর সরদার এলাকার চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী। তাঁর নামে একাধিক মামলা রয়েছে।
মাঠে গিয়ে শাহীন নামের একজনের মুঠোফোন নম্বর জানা যায়। মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি নিজেকে রাজশাহী মহানগর সৈনিক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পরিচয় দিয়ে বলেন, তিনি তো জমি চাষ করছেন না। এলাকার বড় ভাইয়েরা সবাই করছেন। তাঁরা এমনি যান। বড় ভাইদের পরিচয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, পদ্মা গার্ডেনের লিটন ভাই (শামীম রেজা), এলাকার বাদশা ভাই, শান্ত, বাচ্চু, নগর যুবদলের সভাপতি আবুল কালাম আজাদ সুইটসহ অনেকে মিলেই করছেন। কেউ একা করছেন না।
যোগাযোগ করা হলে পদ্মা গার্ডেন ক্লাবের ক্রীড়া সম্পাদক শামীম রেজা ওরফে লিটন দাবি করেন, তাঁরা দরগার জমি চাষ করেন। তিনি একা নন, দরগাপাড়ার সবাই মিলেমিশে করেন। এখানে দরগার ৩০৬ একর জমি রয়েছে। তাঁরা ফসল তুলে দরগা কর্তৃপক্ষকে দানস্বরূপ কিছু দিয়ে থাকেন। জেলা প্রশাসক দরগাকে কাগজ করে দিয়েছেন।
তবে শাহ্ মখদুম রূপোষের (রহ.) দরগা শরিফের দায়িত্বপ্রাপ্ত ‘সরকার’ শরীফুল ইসলাম বলেন, দরগার জমি একসময় ছিল। সেটা পদ্মা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এখন চর জেগে ওঠার পর সরকার থেকে দরগার নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। এ জন্য যাঁরা চাষ করছেন, তাঁদের কাছ থেকেও তাঁরা কিছু চাইতে পারেন না। কারণ, চাইতে গেলেই কাগজপত্র লাগবে। সেই কাগজপত্র দরগার হাতে নেই।
রাজশাহীর ওই পদ্মার চরটির মালিকানা রাষ্ট্রের, রাজশাহী জেলা প্রশাসন রাষ্ট্রের স্থানীয় কর্তৃপক্ষ হিসেবে সেই জমির রক্ষণাবেক্ষণ ও সদ্ব্যবহার করবে, এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু যেভাবে চরটি দখল করে চাষবাসসহ নানা রকমের কর্মকাণ্ড চালানো হচ্ছে, তাতে মনে হয় ওই বিস্তীর্ণ ভূ-সম্পত্তির কোনো মালিকই নেই। ওই দুই ভাই ছাড়াও এলাকার আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, সৈনিক লীগ, বিএনপি, যুবদলের লোকজনসহ আরও অনেক প্রভাবশালী লোক চরটিতে অবৈধভাবে চাষাবাদ করছেন। সরকারের ভূমি বিভাগের স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ৫৩ জন দখলকারীর পরিচয় চিহ্নিত করেছে।
কিন্তু শুধু পরিচয় জানলেই চলবে না। প্রত্যেক দখলকারীকে অবিলম্বে উচ্ছেদ করতে হবে। ভূমি কার্যালয়ের লোকজন মাঠে গিয়ে চাষাবাদকারীদের সতর্ক করে দিচ্ছেন বলে জানা গেছে। কিন্তু সতর্ক করা যথেষ্ট নয়। আরও কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। জেলা প্রশাসনকে চরের সব জমি নিজের নিয়ন্ত্রণে নিতে হবে এবং অবৈধভাবে যাঁরা চরের জমিতে চাষাবাদ করছেন, তাঁদের উচ্ছেদ করতে হবে।প্রথম আলো

মন্তব্যসমূহ