কেওড়া হয়ে সুন্দরবন

নিউজ ডেস্ক:- খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল গেটের সামনেই দুই বন্ধু গড়ে তুলেছেন কেওড়া রেস্টুরেন্ট। সাইকেলে দেশ-বিদেশ ঘোরা এ দুই বন্ধু তাদের স্বপ্ন দিয়ে সাজিয়ে তুলেছেন কেওড়া। পরিপাটি আর গোছানো এই রেস্টুরেন্ট ঘুরে এসে লিখেছেন আশিক মুস্তাফা। ছবি তুলেছেন মাসুদ আনন্দ
রাতের খুলনা। কুয়াশার ডানা ঝাপ্টানি চারদিকে। এই কুয়াশা মাড়িয়ে দু'জন খাবারের প্যাকেট হাতে পথে নেতিয়ে পড়া মানুষদের ডেকে তুলছে। আহারে জীবন। ফুটপাতে শোয়া মানুষগুলোর উঠে বসার শক্তিও নেই যেন। তবু তারা উঠে বসে। আর সেই দুই আগন্তুক তাদের মুখে খাবার তুলে দেয়। তারা খায়। খেতেই থাকে। 'মানুষ খাবার জন্য বাঁচে, না বাঁচার জন্য খায়?' এই প্রশ্ন শুধাই নিজেকে। আগন্তুকরা ক্রিং ক্রিং বেল বাজিয়ে প্যাডেলে চাপ দেয়। কুয়াশায় অদৃশ্য হওয়ার আগেই ডাক দেই। তারা সাইকেলে ঘুরে দাঁড়ায়। এগিয়ে গিয়ে আগ বাড়িয়ে কথা বলি। যত শুনি ততই মুগ্ধ হই। যে দুই বন্ধু একসময় জীবনচাকা টেনে নিতে ঢাকার ফুটপাতে দোকান সাজিয়েছিল, বন-রুটি খেয়ে দিন কাটিয়েছিল- আজ সেই দুই বন্ধু রাতের আঁধারে মানুষের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে। শুধু আজ নয়, তারা রুটিন করে প্রতি রাতেই এমন করে খাবার বিলায়। যারা খাবারের অভাবে পথে-ঘাটে পড়ে থাকে খড়-কুটোর মতো; তাদের পাশে বসে মমতার হাত রাখে পেটে। মানুষ খায়। আর তারা চায়; চেয়েই থাকে। এতেই যে তাদের শান্তি! কারণ তারা বোঝে উপোস থাকার কষ্টটা।
যে স্বপ্ন তাদের ঘুমাতে দেয়নি
এবার দুই বন্ধুর স্বপ্নের পথে হাঁটি চলুন, শরিফুল ইসলাম হিরণ আর বাহারুল ইসলাম। খুলনায় তাদের বাড়ি। একসময় তারা স্বপ্নের চাকা ঘুরাতে ঢাকায় পাড়ি জমিয়েছিল। না, টিকতে পারেনি যান্ত্রিক ঢাকায়। তবে তারা এ ঢাকায় বসেই আরেকটা স্বপ্ন দেখে বসে। এই স্বপ্ন আর তাদের ঘুমাতে দেয় না। তবে এই স্বপ্নে নেই নিজেরাই। শৈশবে দুই বন্ধু সাইকেল চালিয়ে দূর-দূরান্তে চলে যেত। স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য তারা শৈশবের সেই সাইকেলকেই বেঁচে নিল। তারপর টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া তারা সাইকেল চালিয়ে চলে গেল। শুধু গেলই না। পথে পথে তারা মানুষদের জানিয়ে দিয়ে গেল, কোথায় গেলে পাওয়া যাবে ঠোঁককাটা এবং মুগুর-পায়ের রোগীর চিকিৎসা। তাদের কাছে চিকিৎসার খোঁজ পেয়ে প্রায় চার হাজার রোগী চিকিৎসা নিয়ে ভালো হয়ে যায়। ভাবতে পারেন, কী কাণ্ডটাই না ঘটিয়ে দিল এ দুই পাগলা বন্ধু!
এই সেদিনের কথা
শহর থেকে কিছু টাকা জমিয়ে তারা ফিরে এলো নিজের শহরে। এই সেদিন, ২০১৭ সালের কথা। জমানো টাকা আর ধার-দেনা করে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান গেটের বিপরীতে গড়ে তুলল একটা রেস্টুরেন্ট। সুন্দুরবনের কেওড়া গাছ থেকে নাম নিয়ে রেস্টুরেন্টের নাম দিল কেওড়া। এই এক বছরের মাথায় খুলনার নামি-দামি রেস্টুরেন্টের সঙ্গে টেক্কা দেওয়া শুরু করল কেওড়া। তাদের খাবারে মুগ্ধ সবাই। খুলনা শহর থেকে তাদের রেস্টুরেন্ট আর রেসিপির মানের কথা ছড়িয়ে পড়েছে দেশজুড়ে। সুন্দরবন ভ্রমণে যারা যায়, যারা খুলনা শহরে একদিনের জন্যও আবাস গাড়ে, তারাই এই কেওড়ায় ছুটে আসে। কেওড়ার খাবারের স্বাদ আর গন্ধ ভোজনরসিকদের যেন আয় আয় করে ডাকে।
কেওড়ার ভিন্নতা
স্বপ্নবাজ হিরণ আর বাহারুল এখনও সাইকেল চালায়। এখানে-সেখানে যায়। শুধু কি তাই, ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে হিরণ সাইকেলে চেপে বিয়ের কাজটাও সেরে নেয়। ঢাক-ঢোল পেটাচ্ছে মানুষ। আর সাইকেল চালাচ্ছে বর; এই দেখতে বৌ-ঝিরা রাস্তায় নেমে আসে। ছোটরা মায়েদের আঁচল টেনে বলে, 'বড় হলে আমিও সাইকেলে বিয়ে করব মা!' এমন কথা নাকি বর নিজেই শুনেছে! শুধু বিয়ে নয়; দেশের বাইরে গিয়েও তারা সাইকেল চালিয়ে এসেছে। নিয়ে এসেছে রেস্টুরেন্ট পরিচালনার বিদ্যা। তারা তাদের দেখার অভিজ্ঞতা আর রুচিকে কাজে লাগিয়ে কেওড়াকে সাজিয়ে তুলেছে অপরূপভাবে। যে কেউ কেওড়ার আঙিনায় এসে মুগ্ধ হবেন। সুন্দরবন যাওয়ার আগেই খুঁটিনাটি জেনে নিতে পারবেন তাদের রেস্টুরেন্টের দেয়ালে চোখ বুলিয়ে। আর দেয়ালে ঘেরা টেবিল ভালো না লাগলে এসে বসতে পারেন ছাতার তলে। শীতের কুয়াশা মাখানো রোদ আপনাকে আপন করে নেবে। দেবে উষ্ণ অভ্যর্থনা।
যত খাবার
কেওড়ার স্পেশাল খাবার হচ্ছে চুই ঝালের চীনা হাঁসের মাংস ও শাহি পানি। এ ছাড়া সাদা ভাত, পরোটা, ভুনা খিচুড়ি, বিরিয়ানি, চুই ঝালের গরু ও খাসি, বাগদা ও গলদা চিংড়ির মালাইকারি। আছে থানকুনি, ধনিয়া, চিংড়ি, কলা, আলু ও কালি জিরা ভর্তাসহ সব ধরনের শাকসবজি। পাওয়া যায় লেবু-বেলের শরবত, লাচ্ছি, ফালুদা, আইসক্রিম, চা, কফি, কোল্ড ড্রিংকস, চিকেন ফ্রাই, ফিশ ফ্রাই, বারবিকিউ, মোগলাই, চওমিনসহ রাজ্যের খাবার।
তবে এখানে বসে কোনো খাবার খেতে না পারলে তা জানিয়ে রাখলেই হবে। কেওড়ার বেঁচে যাওয়া খাবারের সঙ্গে এই খাবারও রাতে চলে যাবে খেতে না পাওয়া মানুষদের কাছে। তাই বলি, খুলনায় গেলে কেওড়ায় ঢুঁ মেরে এলে দুই ধরনের ভালো লাগা সঙ্গে নিয়ে আসতে পারবেন!
চুই ঝালের চীনা হাঁসের মাংস
উপকরণ : চীনা হাঁসের মাংস ২ কেজি, নারকেল ১টির অর্ধেক, পেঁয়াজ ৫০০ গ্রাম, রসুন ৩০০ গ্রাম, মরিচ গুঁড়া ২ টেবিল চামচ, লবণ ২ চা চামচ, তেল ৪০০ গ্রাম, চুই ১৫০ গ্রাম, আস্ত রসুন ১০০ গ্রাম ও গরম মসলা ২ চা চামচ।
প্রণালি : কড়াইতে ২ লিটার পানির ভেতর হাঁসের মাংস, পেঁয়াজ, রসুন কোয়া, লবণ, তেল একত্রে দিয়ে আধা ঘণ্টা সিদ্ধ করুন। এরপর নারকেলের দুধ দিয়ে কিছুটা নাড়াচাড়া করে ২ মিনিট ঢেকে রাখুন। ২ মিনিট পর চুইঝাল ও আস্ত রসুন দিয়ে ৩ মিনিট ঢেকে রাখুন। এরপর মরিচ গুঁড়া দিয়ে ৫-৬ মিনিট নাড়াচাড়া করে গুঁড়া হলুদ দিয়ে আবারও নাড়াচাড়া করুন। পরে তেজপাতা ও গরম মসলা দিয়ে ২-৩ মিনিট নাড়াচাড়া করে নামিয়ে ফেলুন।
শাহি পানি
উপকরণ : ১ কেজি টক দই, ১ কেজি মিষ্টি দই, ২৫ গ্রাম কাজুবাদাম, ২৫ গ্রাম পেস্তা বাদাম, ১টা লেবু, ২৫ গ্রাম চিনি, ১ চা চমচ বিট লবণ, রুহ্ আফজা ও ২ কাপ বরফ কুচি।
প্রণালি : ডিফ ফ্রিজে রাখা ১ কেজি টক দই, ১ কেজি মিষ্টি দই, কাজুবাদাম ও পেস্তাবাদামের পেস্ট একসঙ্গে ব্লেন্ড করে একটা লেবু থেকে রস নিয়ে চিনি, বিট লবণ দিয়ে ৩ মিনিট ভালোভাবে ব্লেন্ড করুন। এরপর ২০ মিনিট ডিপ ফ্রিজে রাখুন। এবার ফ্রিজ থেকে বের করে আবার ১ মিনিট ব্লেন্ড করে বরফ কুচি-লেবু দিয়ে পরিবেশন করুন।( দৈনিক সমকাল)



মন্তব্যসমূহ